স্টাফ রিপোর্টার: আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ায় এতোদিন গম-ভুট্টার দাম পাচ্ছিলেননা চাষি। এতে একরকম মুখ ফিরিয়েই নিচ্ছিলেন। কিন্তু বৈশ্বিক সংকটে দেশে গম-ভুট্টার আমদানি কমছে। তাতেই চড়েছে বাজার। ফলে লাভের আশায় গম-ভুট্টা চাষে নামছেন উত্তরাঞ্চলের কৃষক।
কৃষি দপ্তরের তথ্য বলছে, রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় ১ লাখ ২৩ হাজার ৬৭১ হেক্টর গম এবং ৭৩ হাজার ৪০৯ হেক্টর ভুট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এবার। অন্যদিকে রংপুর বিভাগের আট জেলায় ১ লাখ ৭ হাজার ৯৫০ হেক্টর গম এবং ২ লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ হেক্টর ভুট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার প্রায় অর্ধেক জমিতে চাষ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবার আশা কৃষি দপ্তরের। এতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, আমদানিতে বাঁচবে বৈদেশিক মূদ্রা। আর এসব আসবে কৃষকের হাত ধরেই।
কৃষকের এই লড়াই সহজ করে দিয়েছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। ৪ শতাংশ বেয়াতি সুদে ৩০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ দিচ্ছে কৃষকদের। এর মধ্যে রংপুর বিভাগের আট জেলার চাষিরা পাবেন ১৯ কোটি টাকা। রাজশাহী বিভাগের আট জেলার চাষিরা পাবেন ১১ কোটি টাকা।
রাকাবের গত ২৭ নভেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ কোটি ৪১ লাখ ২৮ হাজার টাকা ঋণ পেয়েছেন ২ হাজার ৫২০ জন চাষি। এরমধ্যে রাজশাহী বিভাগের ৭২৩ জন পেয়েছেন ৫ কোটি ১ লাখ ৮২ হাজার টাকা। ১১ কোটি টাকা পেয়েছেন রংপুর বিভাগের ১ হাজার ৭৮৮ জন চাষি।
রাকাব আরও জানাচ্ছে, এই বছর শষ্য বা ফসল খাতে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৫০৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এছাড়া চলমান কৃষিতে ২০৪ কোটি ৭০ লাখ এবং কৃষি ও পল্লী ঋণ খাতে ৮৯৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ হয়েছে। এতে উত্তরের অর্থনীতির গতি বদলে যাচ্ছে।
আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের পরিসংখ্যানের দেওয়া তথ্যমতে, গম ২০২১-২০২২ মৌসুমে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ৯৪ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমিতে গম এবং ৫১ হাজার ৭০৭ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছিল। ওই মৌসুমে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৮৫৯ টন গম এবং ৪ লাখ ৮৬ হাজার ২৪৯ টন ভুট্টা ঘরে তুলেছিলেন কৃষক।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, দুই দশক আগেও এই অঞ্চলে গম-ভুট্টার আবাদ ছিলো প্রায় অর্থেক। নানান সংকটে চাষিরা ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু উচ্চ ফলনশীল জাত, চাষের আধুনিক কৌশল এবং বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় কৃষক ফিরেছেন গম-ভুট্টা চাষে।
এই তথ্যের সত্যতা মিলিছে আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে। ২০০৮-২০০৯ মৌসুমে এই অঞ্চলে গমের আবাদ ছিল ৭৯ হাজার ৪৫ হেক্টর। সেইবার গম ফলেছিল ২ লাখ ২৮ হাজার ৫৮৮ টন। ২০১৫-২০১৬ মৌসুম পর্যন্ত প্রতি বছরই এই অঞ্চলে গমের আবাদ বাড়ছিল। ওই বছর ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৪৫ হেক্টর জমিতে ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৯০৫ টন গম উৎপাদন হয়।
পরের বছর থেকেই কমতে শুরু করেছে গম চাষের পরিধি। কিন্তু উঠা-নামা করেছে উৎপাদন। ২০১৬-১৭ মৌসুমে ১ লাখ ৯ হাজার ১৫৬ হেক্টরে ৩ লাখ ৬২ হাজার ১৮৭ টন গম উৎপাদন হলেও ২০২০-২০২১ মৌসুমে ৯৫ হাজার ১৮২ হেক্টরে ৩ লাখ ৫১ হাজার ৬৩৬ টন গম উৎপাদন হয়।
অন্যদিকে, ২০০৮-২০০৯ মৌসুমে রাজশাহী অঞ্চলে ভুট্টার আবাদ ছিল ২১ হাজার ৯০৬ হেক্টর। তা থেকে ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৭ টন। প্রায় দশ বছরের ব্যবধানে চাষের পরিধি এবং উৎপাদন দ্বিগুন ছাড়িয়ে যায়।
২০১৯-২০২০ মৌসুমে ৫০ হাজার ৯৮০ হেক্টরে ভুট্টা ফলেছে ৪ লাখ ৬৮ হাজার ১৭ টন। ২০২০-২০২১ মৌসুমে সর্বোচ্চ ৫৩ হাজার ৬১৫ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। সেই বছর ফলন হয়েছে ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৫১৩ টন।
উচ্চফলনশীন জাত এবং চাষের আধুনিক কলাকৌশল আসায় এই অঞ্চলে গম-ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও রাজশাহী অঞ্চল প্রধান ড. ইলিয়াছ হোসেন।
তিনি বলেন, উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল জাত এবং আধুনিক কৌশলে ভুট্টা-গম চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সার ও বীজ সহায়তাও দেয়া হচ্ছে চাষিদের। এই কাজে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সঙ্গী কৃষি দপ্তর।
বৈশ্বিক সংকট কৃষকদের রাস্তা দেখিয়েছে বলে মনে করেন রাজশাহী অঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক শামছুল ওয়াদুদ। তিনি বলেন, উৎপাদন ঘাটতি থাকায় প্রতিবছরই প্রচুর পরিমাণে গম ও ভুট্টা আমদানি করতে হয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে এবার আমদানি কমেছে।
ফলে দেশের বাজারে বেড়েছে দাম। আর ভালো দাম পেয়ে কৃষক এবার গম চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। আমরাও প্রণোদনাসহ কৃষকের পাশে দাঁড়াচ্ছি। আশা করা যায় এবার রাজশাহী অঞ্চলে গম ও ভুট্টা চাষ এবং উৎপাদনে অতীতের সব রকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।
গম-ভুট্টার আবাদে কৃষক যেনো আর্থিক সংকটে না পড়েন-সেই বিষয়টি দেখছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। বিষয়টি নিশ্চিত করে ব্যাংকের পরিচালক জাহিদুল হক জানিয়েছেন, বৈশ্বিক পস্থিতিতে যেখান থেকে গম-ভুট্টা আমদানি হতো, সেখান থেকে আনা যাচ্ছেনা। আবার কিছু আনা গেলেও দাম বাড়তি।
ফলে আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রা যাচ্ছে। এইসব বিষয় মাথায় রেখে সরকার দেশে গম-ভুট্টা উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কৃষকদের ৩০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে রাকাব। এরই মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৬০ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই খাতে ঋণ বিতরণ চলবে। চাহিদা থাকলে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবার কথাও জানান এমডি।
Leave a Reply