দেশে মাদকাসক্তি তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সবচেয়ে বেশি মাদকের ঝুঁকিতে রয়েছে তরুণরা। এমন পরিস্থিতিতে মাদকাসক্তদের ধর্মীয় মোটিভেশনের মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন করে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে রাজশাহীসহ সাতটি বিভাগীয় শহরে মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার।
সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৭টি বিভাগীয় শহরে ২০০ শয্যাবিশিষ্ট মাদকাসক্ত নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়।
একনেকের উইং সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর এবং গণপূর্ত অধিদফতর। প্রকল্পটি ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪১৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা। যার পুরো অর্থ জোগান দেবে সরকার (জিওবি)। এর বাস্তবায়ন মেয়াদ চলতি বছরের জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২০২৮ সালের জুন পর্যন্ত চলবে। তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় শহরে।
প্রকল্পের উদ্দেশে বলা হয়েছে, বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে মাদকাসক্ত রোগীদের নিকটতম কাছে বা সুবিধাজনক স্থান থেকে উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য সাতটি বিভাগে ২০০ শয্যাবিশিষ্ট মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ। এ ছাড়া দেশের মাদকাসক্তদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। একই সঙ্গে মাদকাসক্ত রোগীদের চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মক্ষম জনবলে পরিণত করা। এ ছাড়া রোগীদের বিনোদনমূলক কার্যক্রম এবং ধর্মীয় মোটিভেশনের মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন করে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে বলছে, প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে, ৬৯.২২ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৭০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ৭২১০৯২. ৩২ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়নে ব্যয় ৪৯ কোটি ৭৭ লাখ, ১১৮৩৩.২৫ বর্গমিটার আবাসিক ভবন নির্মাণে ব্যয় ৬২৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, ৪১৫২.২৭ বর্গমিটার অনাবাসিক ভবন নির্মাণে ২২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা এবং ৩২২১১.৯৭ বর্গমিটারের অন্যান্য ভবন ও স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। এতে খরচ ধরা হয়েছে ৯১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া সাতটি অ্যাম্বুলেন্স ও ৭টি মাইক্রোবাস, হাসপাতালের মেডিকেল যন্ত্রপাতি, ডেস্কটপ কম্পিউটার ৫৪টি, ল্যাপটপ ৮টি, হাসপাতালের আসবাবপত্র, অগ্নিনিরোধক ব্যবস্থাসহ সৌর বিদ্যুতায়ন গ্রিড ফ্রিও কাজ করা হবে।
প্রকল্পের পটভূমিতে উদ্যোগী সংস্থা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়/সুরক্ষা সেবা বিভাগ জানিয়েছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ভিশন হচ্ছে মাদকাসক্তিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে নিবিড় কর্মসম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর দেশে মাদকের ভয়াবহ ক্ষতি হ্রাসে অন্যতম ভূমিকা পালন করে। মাদকাসক্তি একটি শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা। অধিদফতরের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন অধিশাখা মাদকাসক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন করে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে।
উদ্যোগী সংস্থা আরও বলছে, দেশে মাদকাসক্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে ৪টি এবং ৩৮১টি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে, যা দেশে মোট মাদকাসক্ত রোগীর চাহিদার তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। মাদকাসক্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে আধুনিক মানসম্পন্ন নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। এমতবস্থায় সরকারি নিরাময় পুনর্বাসন কেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসার সেবা বৃদ্ধির জন্য ৭টি বিভাগে ২০০টি শয্যাবিশিষ্ট নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ জরুরি বলে উল্লেখ করেছে উদ্যোগী সংস্থা।
এদিকে বেসরকারি সংস্থা মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) হিসাব বলছে, দেশে বর্তমানে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। এর মধ্যে ১ কোটি মাদকাসক্ত এবং বাকি ৫০ লাখ মাঝেমধ্যে মাদক সেবন করে। এ ছাড়া বেড়েছে নারী মাদকসেবীর সংখ্যাও। তথ্য মতে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ মাদকসেবী। গড়ে প্রতি ১২ জনে একজন মাদক নেয়।
মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে পদ্ধতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের পদ্ধতি বা প্রক্রিয়াগুলো নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। একজন ব্যক্তি নিজের ইচ্ছে বা বন্ধুর প্রভাবে বা মাদকের সহজলভ্যতায় হোক মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার যে ব্যবস্থা নিয়েছে সেগুলো রেগুলার অথবা প্রজেক্টভিত্তিক সেবা হিসেবে থাকুক এটি শুধু তাই নয়। একটি প্রজেক্ট নেওয়া হলো, তার প্রেক্ষাপটে কিছু লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলো, কিছু টাকা খরচ হলো এর মধ্যে যেন সীমিত না থাকে। বিশেষ করে মাদকাসক্তদের দোষারোপ করা হয়, তাদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। একজন মাদকাসক্ত কীভাবে হলো তাদের অতীতের ইতিহাস গ্রহণ পর্যালোচনা করে একেকজন ব্যক্তির ওপর একেকভাবে পরির্বতনের পদ্ধতি নির্ধারণ করা জরুরি।
তিনি আরও বলেন, কেউ মাদক থেকে বেরিয়ে এলে কিন্তু চাকরি পাচ্ছে না, সমাজ তাকে গ্রহণ করছে না। তা হলে এ ধরনের দোদুল্যমনা বা টানাপড়েন থাকলে সে হয়তো আবার মাদকের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। একজন মাদকাসক্তকে শুধু মাদক থেকে দূরে রাখলেই সব ঠিক হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়। তাকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সব সুবিধা আগের মতো অগ্রাধিকার দিতে হবে।
পাশাপাশি মাদকমুক্ত সমাজ বির্নিমাণের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং রাজনীতিক ব্যক্তিদের নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক।
অন্যদিকে দেশে মাদকাসক্তদের সুলভ চিকিৎসা এবং কার্যকর পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে সরকার প্রতিটি প্রশাসনিক বিভাগে পুনর্বাসন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় এনজিওদের সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়ে তুলবে। যা অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সঙ্গে প্রকল্পের সংগতি রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের ভাষ্য, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মাদকাসক্তদের চিকিৎসাসেবা দান করে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। এ ছাড়া রোগীদের চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মক্ষম জনবলে পরিণত করা, রোগীদের বিনোদনমূলক কার্যক্রম এবং ধর্মীয় মোটিভেশনের মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন করে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনা সহজ হবে।
এ ছাড়া প্রকল্পটি নিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের ১২ তারিখে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কতিপয় সিদ্ধান্ত প্রতিপালন সাপেক্ষে প্রকল্পটি অনুমোদনের সুপারিশ করে পিইসি।
Leave a Reply