দলের দুইপক্ষের সংঘর্ষে নিহত রাজশাহীর বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুলের জানাজায় গিয়ে লাঞ্ছিত হয়েছেন দলের জেলা কমিটির সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল কুমার সরকার। হাত ধরে টেনে তাকে বাবুলের লাশের পাশ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনিল কুমার সরকারের সাথে যখন এ ঘটনা ঘটে, তখন পাশেই বাবুলের লাশ সামনে নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনের সংসদ সদস্য ও বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহরিয়ার আলম।
বাবুলের মৃত্যুর জন্য তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন; রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ এবং বাঘা উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লায়েব উদ্দিন লাভলুকে দোষারোপ করেন।
শাহরিয়ারের এমন বক্তব্যে রাজশাহী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগে উত্তাপ দেখা দিয়েছে। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
মঙ্গলবার (২৫ জুন) বেলা ১১টায় বাঘা মডেল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বাবুলের জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। লাশ সামনে রেখে বক্তব্য দিতে গিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, খুনি আক্কাস (পৌর মেয়র), খুনি মেরাজ (ইউপি চেয়ারম্যান)। তাদের পেছনে মদতদাতা আছে। দুই বছর আগে আক্কাস বহিষ্কৃত হয়েছিলো আওয়ামী লীগ থেকে। খায়রুজ্জামান লিটন নিজের মুখে সেই কথা এখানে বলেছিলেন। এস এম কামাল বলেছিলেন, সে বহিষ্কৃত। এ ঘোষণার সাত দিনের মাথায় খায়রুজ্জামান লিটনের গাড়িতে আক্কাস ও মেরাজকে ঘুরতে দেখা গেছে।
শাহরিয়ার বলেন, আমরা জবাব চাই, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের কাছে। অ্যাডভোকেট লায়েব উদ্দিন লাভলুর কাছে জবাব চাই, সে কেন আজ পলাতক? খুনের মামলায় দুজন সশরীর উপস্থিত ছিলো। পেছন থেকে মদতদাতা হিসেবে আসাদুজ্জামান আসাদ, এএইচএম খায়রুজ্জামান এবং লায়েব উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা হবে। তাদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথে থাকব। আমাদেরও দায়িত্ব আছে।
শাহরিয়ার আলম বলেন, কারা বাঘা থেকে রাজশাহীতে গিয়ে শক্তি সঞ্চার করে? আমি প্রশাসনকে বলব- এই যে ব্যক্তি কয়েকজনের নাম বললাম, আসামিদের টেলিফোন নাম্বারের সাথে, সাতদিনের টেলিফোন মিলায়ে নেবেন। তাদের সাথে যদি দিনে পাঁচবার করে কথা না হয়, আমি সংসদ সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে যাব। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি প্রশাসনকে। শাহরিয়ার আলম যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রতিমন্ত্রী ও রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের সংসদ সদস্য আবদুল ওয়াদুদ দারা, রাজশাহী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার।
শাহরিয়ারের ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল কুমার সরকার। তাকে হাত ধরে টেনে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ দারার সাথে সভাপতি অনিল কুমারের মতবিরোধ রয়েছে।
অনিল কুমার সরকার অভিযোগ করেছেন, তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে জানাজার স্থান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নিহত বাবুলকে শ্রদ্ধা জানাতে একটি ফুলের ডালাও নিয়ে গিয়েছিলেন। সেটিও মরদেহে দিতে দেওয়া হয়নি।
অনিল কুমার সরকার বলেন, আমাকে দেখে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পুঠিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ মোল্লা অপমানজনক কথা বলেছেন। আমাকে বলা হয়, আপনি এখানে কেন? আপনি বেরিয়ে যান। এরপর পুঠিয়া উপজেলা কৃষকলীগের সভাপতি রাজিবুল হক হাত ধরে টেনে আমাকে সেখান থেকে বের করে দেয়।’
অনিল বলেন, দলের একজন নেতা মারা গেছেন, আমি গিয়েছি। সেখান থেকে বের করে দেওয়া শোভনীয় নয়। বিষয়টি আমি দলকে জানাব। দলের সভানেত্রী নিশ্চয় এর বিচার করবেন।
এদিকে এব্যাপারে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদ রেনেসাঁস নিউজকে বলেন, রাজনীতিকে তারা অন্যখাতে প্রবাহিত করে ফায়দা লুটতে চায়। এ কারণেই তারা আমার নাম ব্যবহার করেছে। শাহরিয়ার আইনগতভাবে প্রমাণ করুক। সাতদিন না, সাত মাসের কল রেকর্ড তুলে দেখেন। প্রমাণ করতে না পারলে শাহরিয়ারকে আইনের মুখোমুখি করবো। এটা আমার মান-সম্মানের ব্যাপার।
অন্যদিকে, বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) বিকেলে শাহরিয়ারের বক্তব্যের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি বলেন, বাবুল যখন ছাত্রনেতা, তখন থেকেই তাকে আমি পাশে পেয়েছি। তাকে হত্যার মতো নিন্দনীয়-নৃশংস হত্যার সাথে আমি কোনোভাবে জড়িত থাকার কোনো কারণ নেই, কোনো সুযোগ নেই। জানাজায় আমার নাম ধরে এলাকার বর্তমান এমপি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ঈর্ষাপরায়ণভাবে এ রকম উক্তি করতে পারেন, সেটা আমার বোধগম্য নয়। তার কাছ থেকে এটা আশাই করিনি। কী উদ্দেশ্যে, কেন তিনি বলেছেন তা তিনিই বলতে পারবেন। যারা বিবেকসম্পন্ন মানুষ তারা এটাকে সমর্থন করবেন না।
লিটন সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চেয়ে বলেন, আমার বয়স এখন ষাটের ওপরে। আমার রাজনৈতিক জীবনে এ ধরনের ঘটনায় মদদ দেওয়ার ইতিহাস নেই, মনে হচ্ছে যেন লাশটি কারও দরকার ছিলো। একজনের মৃতদেহ দরকার ছিলো যেটাকে পুঁজি করে রাজনীতি করা যায় এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়। আমার কাছে এটাই মনে হচ্ছে। আমরা যারা আওয়ামী লীগের রক্ত নিয়ে বড় হয়েছি, তাদেরকেই এখন হেনস্থা করার অপচেষ্টা করছেন নতুনেরা।
গত ২২ জুন বাঘা উপজেলা সদরে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুরুত্বর আহত হন বাবুল।
বুধবার বিকেলে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ সংঘর্ষের নেপথ্যে ছিলো বাঘা উপজেলা দলিল লেখক সমিতির বাড়তি টাকা আদায়কে সমর্থন দেওয়া বা না দেওয়া নিয়ে। আওয়ামী লীগের দুপক্ষের সংঘর্ষের পর দলিল লেখক সমিতির পক্ষ থেকে থানায় মামলা করা হয়। সেই মামলাটিই হত্যা মামলায় রূপ নেবে।
এ মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান মেরাজুলসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পুলিশ সাত আসামির পাঁচদিন করে রিমান্ডের আবেদন করেছিলো। বৃহস্পতিবার আদালত আসামিদের একদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
Leave a Reply