আমাদের দেশে দুধকে বলা হয় গরিবের প্রোটিন। শিশুর বাড়ন্তে এসব পুষ্টি ও ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস খুবই জরুরি। বিশেষ করে দুধে প্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের পুষ্টি উপাদান থাকে। তাই নিয়মিত দুধ খাওয়া খুবই উপকারী। তবে খাবারের তালিকা থেকে বাড় পড়ছে এই প্রোটিন। দুধের দাম বেড়ে যাওযায় এর প্রভাব পড়ছে নিম্ন আয়ের পরিবারের ওপর। এতে করে শিশুর খাদ্য তালিকায় কমছে পুষ্টিকর খাবার।
ক্রেতারা বলছেন, সুষম খাবারের প্রয়োজন মেটাতে অনেক পরিবার খাদ্য তালিকায় তরল দুধ রাখেন। সেটার দামও বাড়তি। এতে নিম্ন আয়ের মানুষেরাও বিপাকে পড়েছন বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
এদিকে বিক্রেতাদের দাবি, প্রান্তিক খামারিদের কাছ থেকেই বাড়তি দামেই দুধ কিনতে হচ্ছে। গো-খাদ্যের দাম বাড়তি এবং শ্রমিকের মজুরিবৃদ্ধিসহ প্যাকেটজাতকরণেও খরচ বেড়েছে বলে দাবি করছেন তারা।
মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে জানা গেছে, প্যাকেটজাত তরল দুধের দাম লিটারে ১০ টাকা বাড়িয়েছে প্রক্রিয়াজাতকারী বেসরকারি খাতের কোম্পানি ব্র্যাক ডেইরি। এক লিটার তরল দুধের দাম বাড়িয়ে ৯৮ টাকা নির্ধারণ করেছে কোম্পানিটি। আধা লিটারের দুধের দাম ৫০ টাকা করা হয়েছে।
এছাড়া আড়ংয়ের স্ট্যান্ডার্ডাইজড দুধ আধা লিটারের ৫৫ টাকা, এক লিটার ১০০ টাকা, পাস্তুরিত দুধ আধা লিটার প্যাকেট ৬০ টাকা এবং এক লিটার প্যাকেট ১০৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
জানা গেছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয়বৃদ্ধির কারণে ব্র্যাক ডেইরি চলতি সপ্তাহ থেকে আড়ং দুধের মূল্য লিটারপ্রতি ১০ টাকা বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে।
ব্র্যাক ডেইরি বলছে, ২০২২ সালের জুলাই মাসে পণ্যের সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছিল। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বাজারে সংশ্লিষ্ট কাঁচামাল যেমন: প্যাকেজিং, কার্টন ও খুচরা জিনিসের মূল্য ২০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণেও দুধ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিতরণ খাতে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে।
সংস্থাটি আরো জানিয়েছে, বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় দুধ শীতলকরণসহ প্রক্রিয়াজাত কারখানায় অনেক বেশি সময় জেনারেটর ব্যবহার করতে হচ্ছে। এছাড়া ডলারের মূল্যবৃদ্ধি হওয়ায় আনুষঙ্গিক ব্যয়ও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
রাজধানীর মিরপুর-১৩ প্রিন্স বাজার সুপারশোপের এক বিক্রয়কর্মী বলেন, আড়ং দুধ লিটারে ৫ থেকে ৭ টাকা বেড়েছে। প্রাণ ডেইরি মিল্ক লিটারে বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়। ফ্রেশ দুধ লিটারে বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা। এয়াড়া মিল্কভটা লিটারে বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়। আধা লিটার বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা। তবে রকমভেদে আধা লিটার দুধের জন্য ক্রেতাদের বাড়তি গুণতে হয় ৭ থেকে ৫ টাকা। আধা লিটার দুধ বিক্রি হয় ৫২ টাকায়। তবে সেটা রকমভেদে।
নাম প্রকাশ না করে মিরপুর-১৩ এলাকার জানান, শিশুর পুষ্টিকর খাদ্য তালিকায় নিয়মিত দুধ রাখেন। তবে আগে যে পরিমাণ রাখতেন সেটা তিনি কমিয়েছেন। নিত্যপণ্যের যে দাম তাতে সংসার খরচ টানতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে এক লিটার দুধ কিনতেও এখন ভাবতে হচ্ছে।
একই এলাকার আরেক বাসিন্দা বলেন, সংসারে আয়ের চেয়ে খরচ বেশি। অভাবী সংসারের টানা পড়েনে বাচ্চাদের পুষ্টিকর খাবারের দিকে নজর রাখাই দু:ষ্কর।
রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকার ভাই ভাই জেনারেল স্টোরের মালিক মো.শাহজাদ হোসেন বলেন, প্যাকেটজাত তরল দুধে শুধু আড়ংয়ের দাম বেড়েছে। তবে গুঁড়ো দুধের দাম বাড়েনি। ডিপ্লোমেটিক আধা কেজি গুড়ো দুধের দাম ৬মাস আগে ছিলো ৪২৫ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৪৫ টাকায়। তবে শিশুর পুষ্টিকর খাদ্যে ব্যবহারে যেমন হরলিক্স ও সেরোলাকের দাম বাড়েনি।
দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন সব জিনিসের দামই বাড়তি। এর ধারাবাহিকতায় গরুর খাদ্যের দাম, প্রান্তিক খামারিদের শ্রমিকের মজুরী এবং প্যাকেটজাত পক্রিয়াকরণেও বাড়তি খরচ গুণছে। এর ফলে দাম বাড়তে পারে। তবে শুধু আড়ং দুধের দাম বাড়ালেও অন্যান্য কোম্পানিগুলো দ্রুতই দাম বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গবাদি পশুর খাদ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় কৃষক পর্যায়ে দুধের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। সেজন্য কৃষক পর্যায়ে কাঁচা দুধের মূল্য লিটার প্রতি ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা (ইউএসএআইডি) বলছে, বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ গর্ভবতী মা ও শিশু আগে থেকেই পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। লাগামহীন দাম বাড়ার কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ খাবারের পরিমাণ কমালে সামনে পুষ্টিহীনতার অবস্থা আরো বাড়তে পারে।
জুন মাসে ‘শৈশবকালীন খাদ্য সংকট : প্রারম্ভিক শৈশবে পুষ্টি বঞ্চনা’ শীর্ষক ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে প্রতি ৩ জন শিশুর মধ্যে ২ জনই সুষম খাদ্য সংকটের মধ্যে বাস করে।
ইউনিসেফ বলছে, শৈশবকালীন পর্যাপ্ত সুষম খাবারের ঘাটতি সব শিশুর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, তবে এর বিশেষ প্রভাব দেখা যায় শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে।
বাংলাদেশ নিউট্রিশন অ্যান্ড ডায়েটেটিকস ফোরামের (বিএনডিএফ) সভাপতি এবং বারডেম হাসপাতালের পুষ্টি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শামসুন নাহার নাহিদ গুমাধ্যমে বলেন, আয়ের তুলনায় ব্যয় বাড়ায় স্বাভাবিকভাবেই স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। খাদ্য তালিকা কাটছাঁট করতে তারা বাধ্য হচ্ছেন। এর ফলে অনেকের খাদ্য তালিকা থেকে স্নেহ ও প্রোটিনের উৎসগুলো বাদ পড়ছে। এতে পুষ্টির ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।
এই পুষ্টিবিদ আরো বলেন, শিশুরা কম খেলে বা অতিপ্রয়োজনীয় পুষ্টিগুলো না পেলে পুষ্টিহীনতায় ভুগবে, খর্বাকার হয়ে পড়বে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। সরকারকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা মেটানোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সঙ্গে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষদের এগিয়ে আসা জরুরি।
Leave a Reply